
আমার চার বছরের শিশুপুত্রকে রেখে ওর মা পালিয়েছে।
প্রথমদিকে আচমকা মায়ের অভাব সামাল দিতে হিমসিম খেতাম।
এখন কিছুটা সহজ হয়েছে।
ছেলে এখন রোজ নিয়ম করে দুই বেলা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে।
কথা শেষ হলে কানে গুঁজে দেয়া ইয়ার-ফোন সরিয়ে রেখে বড়দের মতো মুখ গম্ভীর করে রাখে।
আরও বেশি গম্ভীর হয়ে আধো-বোল ফোটা মুখে বলে, আম্মু আমাকে কাঁদতে নিষেধ করেছে।
আমি কি কাঁদছি আব্বু?
আমি অন্তুর ছোট্ট মুখটির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না।
বুকের মধ্যে খঁচখঁচ করে। কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে!
অন্তুর মা চলে যাওয়ার পর থেকে ওর নানা-নানু দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন।
বলা যায় একপ্রকার জোর করেই নিয়েছেন।
গ্রামে বিয়ে দেয়া একটি বোন ছাড়া কাছের আর কোন আত্মীয় আমার নেই।
শ্বশুর-শাশুড়ির মূল ভয়টা সেখানেই।
চাকরিজীবী একা হয়ে যাওয়া মানুষ দুধের বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবে?
আমি সাপ্তাহিক ছুটির দিনের অপেক্ষায় থাকি।
এই একটি দিন অন্তু আমার কাছে থাকে। ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হই।
মাঝেমাঝে কিছু দিন আসে, আমাদের বেশিক্ষণ ঘোরা হয় না।
কোন মা তাঁর সন্তানকে আদর করছে এমন দৃশ্য দেখলে অন্তু থমকে যায়।
বুভুক্ষের মত চেয়ে থাকে সেদিকে।
আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আব্বু! আমার আম্মু কবে আসবে?
বুকের ভেতর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। মৃদু হেসে উত্তর দেই, তুমি যখন অনেক বড় হবে।
অন্তু নীচের ঠোঁট ভেঙে দিয়ে বলে, আমি কবে বড় হবো?
কৌশলে কথা ঘুরিয়ে ফেলি আমি। দ্রুত অন্তুকে নিয়ে বাসায় ফিরি।
আমার কাছে থাকার সময়টাতে শ্বশুর-শাশুড়ি বেশ চিন্তায় থাকেন।
একটু পরপর ফোন দিয়ে খোঁজ নেন। আজও দুবার খোঁজ নেয়া হয়ে গেছে।
অন্তু কি কান্নাকাটি করছে বাবা?
না আম্মা। খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে।
আজ ওর মায়ের সাথে কথা বলেছে?
জ্বি বলেছে।
শাশুড়ি আর কথা বাড়ান না। ফোনের ওপাশে অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে।
আজ ছুটির দিন দেখে বাথরুমের বালতীতে কিছু জামাকাপড় ভিজিয়ে ছিলাম।
ধুতে যাবো এমন সময় গগনবিদারী চীৎকার! আব্বু...............
কিচেনে গিয়ে দেখি, অন্তু আঙ্গুল একটা চেপে ধরে ফুঁ দিচ্ছে আর উস-উস করে শব্দ করছে।
চুলা নেভানো থাকলেও পাতিল গরম ছিল।
খেলতে-খেলতে এক ফাঁকে তার মনে হয়েছে বাবার জন্য চায়ের পানি বসাতে হবে।
এই কাজটি অন্তু ওর নানুর কাছ থেকে শিখেছে।
বার্নল লাগিয়ে দিলাম।
মোমের মতো ফর্সা কচি সরু আঙুলে দেখতে-দেখতে ফোসকা পড়ে গেলো।
অন্তুর লালাভ চোখের ঘন কালো দীর্ঘ পাপড়ি জুড়ে জলের বিন্দুগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আম্মু না তোমাকে কাঁদতে নিষেধ করেছে অন্তু বাবা!
ছেলে দুহাতের তালু দিয়ে চোখের পানি আড়াল করে ফেললো।
লজ্জিত মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আজ রাতে আম্মুর সাথে তাহলে দুই বার কথা বলব হুম?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেই। অন্তু খুশি হয়ে আমার বুকের সাথে ওর মাথার একপাশ চেপে ধরে রাখে।
কতো ভালোবাসার ধন আমাদের! অবন্তী নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলো।
অফিসের ব্যস্ততায় সময় কম দিতে পারতাম। এজন্য মান-অভিমান কম হয়নি।
অবন্তী প্রায়ই বলতো, ছেলে কিন্তু জন্মদাতা বাবাকেই চিনবে না দুদিন পর, দেখে নিও।
আমি খবরের কাগজে মুখ ঢেকে হাসতাম।
অবন্তীর রাগ বেড়ে যেতো, বোকার মতো হাসছ কেন?
বাবু ঘুমে থাকতেই বের হয়ে যাও। ফেরো রাতে আবার ঘুমিয়ে পড়লে।
প্রাইভেট চাকরী! তাছাড়া তুমি তো আছো! হাহাহা
আবারো হাসছ? বিরক্তিকর!
অবন্তী উঠে চলে যেতে-যেতে বলতো,
মন চায় অন্তত একটা দিন ছেলেকে তোমার কাছে রেখে পালাতে পারতাম যদি!
বাবা সেজেছো, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করা কী জিনিষ টের তো পাও না!
অবন্তী কথা রাখেনি। একটা দিনের জায়গায় পুরো দুটো মাস হতে চলল
অবন্তী পালিয়েছে। ফেরেনি আর!
অথচ কী ভালোবাসাটাই না বাসতো আমাকে! কথায় কথায় বুদ্ধদেব বাবুর কথা শোনাতো।
যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, কেবল মাত্র তাঁরাই ভালোবেসে সবকিছু হারাতে পারে।
অবন্তীও অনেককিছু পেছনে ফেলে রেখে এক সন্ধ্যায় আমার মেসের সামনে এসে
রিক্সা থেকে নেমে বলেছিল, চলে আসলাম একেবারে।
বাবা-মা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছে।
কাল বিকেলে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা।
এখন উপায়?
উপায় আর কী? আবার একটা রিক্সা ঠিক করো।
আমাকে আমাদের বাসায় পৌঁছে দেও।
অবন্তীর কথায় হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না।
বললাম, এই না বললে একেবারে চলে এসেছো?
অবন্তী হেসে গড়িয়ে পড়লো।
আরে বুদ্ধু! এটা আমার একটা ট্রিক্স। একটা চিঠি লিখে তারপর পালিয়েছি।
এতক্ষণে ওদের ধারণা হয়ে গেছে
আমি অলরেডি তোমাকে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।
এখন তাঁরা যদি দেখে তুমি আমাকে সুযোগ পেয়েও তাঁদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করোনি।
বরং সসম্মানে ঘরের মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছো তাহলে তোমার উপর তাঁদের আস্থা বাড়বে। দম আটকানো সারপ্রাইজ। ঠিক কি না তুমিই বলো? হিহিহি
অবন্তীর দম আটকানো সারপ্রাইজের কথা শুনে আমার নিজেরই দম আটকে যাওয়ার অবস্থা হলো। অবাক হওয়ারও ভাষা হারিয়ে ফেললাম। একটা রিক্সা ডেকে চেপে বসলাম।
অবন্তী আমার হাতের আঙ্গুল খুঁটতে-খুঁটতে বলল, পাত্র ডাক্তার।
আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন।
বললাম, আগে জানাওনি তো।
আগে জানালে কী করতে? ডাক্তারের সাথে ফাইট করতে? তুমি বাংলা সিনেমার হীরো?
শোনো, তুমি হচ্ছ ফুটপাথ-মানব! ওদের সাথে তুমি পারবা না।
তোমার মতো ফুটপাত-মানবকে আমাদের বাসার কেউ মেনে নিচ্ছে না।
অবশ্য মেনে নেয়ারও কিছু নেই। তুমিই বলো, তোমাকে মেনে নেয়ার কিছু আছে?
না নেই।
আর কিছু বললাম না।
রিক্সায় পাশে বসে অবন্তী কিছুক্ষণ নিবিড় দৃষ্টি নিয়ে আমার বিষণ্ণ মুখ দেখলো।
অবাক করে দিয়ে আমার হাত মুঠোয় পুরে হু-হু করে কেঁদে ফেললো, তুমি চিন্তা করো না।
সব ঠিক করে ফেলবো। আমি তোমার মতো গাধা না। এবার একটু হাসো তো!
আশ্চর্য একটা মেয়ে। নিজে কাঁদছে আর আমাকে বলছে হাসতে।
অবন্তীকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে গেলো।
ওর বাবা প্রেশার বাড়িয়ে কোঁ-কোঁ করছিলেন।
তিনি ঐ অবস্থায় উঠে এসে মেয়েকে কষে থাপ্পড় লাগালেন ঘর ভরা মানুষের সামনে।
আমাকে বললেন এক্ষুনি যেন চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যাই।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বের হয়ে আসলাম।
ঘটনার দুই ঘণ্টার মাথায় ফোন পেলাম।
অবন্তীর বাবা টেনে-টেনে বললেন, চাকরী-বাকরি কি কিছু করো?
জ্বি। ছোট একটা করি।
দশ মিনিটের মধ্যে কাজী নিয়ে সোজা বাসায় আসো।
বউ নিয়ে বিদায় হও। কোনোদিন শ্বশুরবাড়ির ত্রিসীমানায় যেন না দেখি।
কথা ক্লিয়ার?
জ্বি ক্লিয়ার।
কাজী আনার পয়সা আছে তো? না কি ওটাও আমার দিতে হবে?
লোক মুখে শুনেছি অমৃত না কি সোনার পাত্রে রাখতে হয়।
পাঁচ বছর আগের এক হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত ভেদ করে সূর্যের
প্রথম পবিত্র আলোর মতো সাত রাজার ধন এলো আমার দরিদ্র কুঠুরিতে।
সেই সাদামাটা কুঠুরিতে অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে বুকে আছড়ে পড়ে বলেছিল, কথা দিচ্ছি কোনোদিন ছেড়ে যাবো না। তুমি শুধু আমার থেকো, কেমন?
মেয়েটি এবারও কথা রাখেনি। দুই-দুটো মাস পার হতে চলেছে। আমার বুক খাঁখাঁ করে!
রাতে বাপ-বেটা অনেকক্ষণ ভিডিও-গেম খেললাম।
বহুদিন পর আমার হাতে অন্তু ভাত খেলো।
টের পেলাম, বাচ্চাকাচ্চার সামান্য খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটাও কতো কঠিন।
দু লোকমা মুখে দিয়েই অন্তু তার কমন অভিনয় শুরু করলো।
আব্বু কাঁতা!
কাঁতা মানে কাঁটা। আমি হেসে ফেললাম। ভাত মেখেছি ডিম দিয়ে।
কাঁটা আসবে কোত্থেকে? না খাওয়ার কতো বায়না ছেলের।
আমি ভাতগুলো মুঠি পাকিয়ে ভাত-ডিম বানিয়ে দেই। একটা ডিম আমার নামে।
তিনটি ডিম ওর মায়ের নামে।
অন্তু কেবল ওর মায়ের নামে রাখা পাকানো ডিম গুলো
মুখ পুরে খায় আর কুটকুট করে হেসে বলে, খাওয়া শেষ।
এখন আম্মুর সাথে কথা বলবো। ফোন দাও আব্বু!
রোজ ফোনে মায়ের সাথে একই গল্প।
শুনতে-শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। অবন্তী থেমে-থেমে প্রথমদিকে কিছু প্রশ্ন করবে।
অন্তু সোনা কেমন আছো?
ভাল আছি আম্মু।
অবন্তী একটু থেমে আরেকটা প্রশ্ন করবে।
তার আদরের পুত্র সেভাবেই উত্তরের পর উত্তর দিয়ে যাবে।
এরপর অবন্তী ছোট একটা গল্প শোনাবে ছেলেকে। গল্পে একজন রাজপুত্র থাকবে।
রাজপুত্রের বয়স অনেক কম। রানীমা তাকে শর্ত দিয়েছে।
রাজপুত্র বড় হলেই কেবল সে রাজ্যে ফিরবে।
ছোট রাজপুত্র তার মাকে উদ্ধার করার জন্য তেপান্তরের মাঠে ঘোড়া ছুটাবে।
ঘোড়া ছুটতে-ছুটতে রাজপুত্র বড় হতে থাকবে।
এক পর্যায়ে গল্প শেষ হবে। অন্তু নামের একজন রাজপুত্র মোবাইলের স্ক্রিনে চুমু খাবে।
তার ক্লান্ত চোখ বড় হয়ে আম্মুকে ফিরিয়ে আনার প্রহর গুণতে-গুণতে ঘুমিয়ে পড়বে।
পুত্র ঘুমালেও আরেক জোড়া চোখ সারারাত জেগে থাকবে সূর্যদয়ের অপেক্ষায়।
নির্ঘুম চোখ জোড়া পুত্রের বাবার।
মাত্র দু মাস আগের এক গভীর রাত্রিতে অনাড়ম্বর এক নার্সিং হোমের বেড-এ শুয়ে অবন্তী বলেছিল, তোমার কোলে মাথা রেখে সকালের প্রথম সূর্যটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে জানো?
মাত্র প্রথম রাউন্ড কেমো দেয়া শুকনো মুখটি কোলের উপর টেনে নিতেই
অবন্তী মৃদু হাসলো একবার।
বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, সময় মনে হচ্ছে বেশি নেই।
তোমার মোবাইলের রেকর্ড অপশনটা চালু করো দ্রুত।
আমার ছেলেটা এখনও বাচ্চা।
হঠাৎ মাকে না পেয়ে খুব কাঁদবে কিছুদিন।
তখন রেকর্ডটা ওর কানে দিয়ে দিবা, কেমন?
অবন্তীর আর শেষ সকালটা দেখা হয়নি।
জনমের মতো আমার ভীষণ তেজোদ্দীপ্ত সূর্যটি অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে
অনন্ত শূন্যে পালিয়ে গেলো রেকর্ডিং-এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।
আমি কম্পিত হাতে মোবাইলের রেকর্ডিং চালু করি।
অন্তু অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
ওর কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে দিয়ে আমি খোলা জানালায় গিয়ে দাঁড়াই।
অন্তু বিছানায় একটা বালিশ জড়িয়ে নিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প শুরু করে।
বালিশের উপরে ছয় বাই ছয় সাইজের একটি মায়ের মুখ ফ্রেমের ভেতর থেকে
অন্তুর দিকে হাসি ছড়িয়ে চেয়ে থাকে। মুখটি অন্তুর মায়ের।
মুখটি অনন্তে ভেসে থাকা আমার ভীষণ অভিমানী একটি তারার।
আমি জ্বলজ্বল করতে থাকা আকাশের সবচেয়ে কাছের তারাটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
তারাটি কেঁপে-কেঁপে ওঠে চোখের তারায় লেপটে গিয়ে।
1 Comments
This comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDelete