রহমান রহীম আল্লাহ তায়ালার নামে
বিভিন্ন প্রকরের “খতম” এর বিদ’আত
লিখেছেনঃ ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
লিখেছেনঃ ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রকারের ‘খতম’
প্রচলিত আছে। এধরনের ‘খতমের’ নিয়ম, ফজীলত ইত্যাদির বিবরণ ‘মকসুদুল
মোমিনীন’, ‘নাফেউল খালায়েক’ ইত্যাদি বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়। সাধারণত,
দুটি কারণে ‘খতম’ পাঠ করা হয়:
(১) বিভিন্ন বিপদাপদ কাটানো বা জাগতিক ফল লাভ;
(২) মৃতের জন্য সাওয়াব পাঠানো।
(২) মৃতের জন্য সাওয়াব পাঠানো।
উভয় প্রকারের খতমই ‘বানোয়াট’ ও
ভিত্তিহীন। এ সকল খতমের জন্য পঠিত বাক্যগুলি অধিকাংশই খুবই ভাল বাক্য।
এগুলি কুরআনের আয়াত বা সুন্নাহ সম্মত দোয়া ও যিকর। কিন্তু এগুলি এক লক্ষ
বা সোয়া লক্ষ বার পাঠের কোনো নির্ধারিত ফযীলত, গুরুত্ব বা নির্দেশনা কিছুই
কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বলা হয় নি। এ সকল ‘খতম’ সবই বানোয়াট। উপরন্তু
এগুলিকে কেন্দ্র করে কিছু হাদীসও বানানো হয়েছে। ‘বিসমিল্লাহ’ খতম, দোয়া
ইউনুস খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের। বলা হয় ‘সোয়া লাখ বার
‘বিসমিল্লাহ’ পড়লে অমুক ফল লাভ করা যায়’ বা ‘সোয়া লাখ বার দোয়া ইউনূস
পাঠ করলে অমুক ফল পাওয়া যায়’ ইত্যাদি। এগুলি সবই ‘বুজুর্গ’দের অভিজ্ঞতার
আলোকে বানানো এবং কোনোটিই হাদীস নয়।
তাসমিয়া বা (বিসমিলাহ), তাহলীল বা (লা
ইলাহা ইলালাহ) ও দোয়া ইউনুস- এর ফযীলত ও সাওয়াবের বিষয়ে সহীহ হাদীস
রয়েছে। তবে এগুলি ১ লক্ষ, সোয়া লক্ষ ইত্যাদি নির্ধারিত সংখ্যায় পাঠ করার
বিষয়ে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। “খতমে খাজেগানের” মধ্যে পঠিত কিছু দোয়া
সুন্নাহ সম্মত ও কিছু দোয়া বানানো। তবে পদ্ধিতিটি পুরোটাই বানানো।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, এ সকল খতমের কারণে
সমাজে এ ধরণের “পুরোহিততন্ত্র” চালু হয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা হলো,
বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ইউনূস (আ)-এর মতই নিজে “দুআ ইউনূস” বা অন্যান্য সুন্নাহ
সম্মত দুআ পড়ে মনের আবেগে আল্লাহ্র কাছে কাঁদবেন এবং বিপদমুক্তি
প্রার্থনা করবেন। একজনের বিপদে অন্যজন কাঁদবেন, এমনটি নয়। বিপদগ্রস্ত
মানুষ অন্য কোনো নেককার আলিম বা বুজুর্গের নিকট দুআ চাইতে পারেন। তবে এখানে
কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে:
🔴
(১) অনেকে মনে করেন, জাগতিক রাজা বা মন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে যেমন
মধ্যস্থতাকারী বা সুপারিশকারীর প্রয়োজন, আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করতেও
অনুরূপ কিছুর প্রয়োজন। আলিম-বুজুর্গের সুপারিশ বা মধ্যস্ততা ছাড়া
আল্লাহ্র নিকট দুআ বোধহয় কবুল হবে না। এ ধরনের চিন্তা সুস্পষ্ট শিরক।
জাগতিক সম্রাট, মন্ত্রী, বিচারক বা নেতা আমাকে ভালভাবে চিনেন না বা আমার
প্রতি তার মমতা কম এ কারণে তিনি হয়ত আমার আবেদন রাখবেন না বা পক্ষপাতিত্ব
করবেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এরূপ চিন্তা করা যায়? ইসলামের
বিধিবিধান শিখতে, আত্মশুদ্ধির কর্ম শিখতে, কর্মের প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেতে
বা আল্লাহর জন্য ভালোবাসা নিয়ে আলেম ও বুজুর্গগণের নিকট যেতে হয়।
প্রার্থনা, বিপদমুক্তি ইত্যাদির জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হয়।
🔴
২) কুরআন কারীম ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, যে
কোনো মুমিন নারী বা পুরুষ যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজের মনের আবেগ
প্রকাশ করে দুআ করলে ইবাদত করার সাওয়াব লাভ করবেন। এছাড়া আল্লাহ তার দুআ
কবুল করবেন। তিনি তাকে তার প্রার্থিত বিষয় দান করবেন, অথবা এ প্রার্থনার
বিনিময়ে তার কোনো বিপদ কাটিয়ে দিবেন অথবা তার জন্য জান্নাতে কোনো বড়
নিয়ামত জমা করবেন।
🔴
৩) নিজে দুআ করার পাশাপাশি জীবিত কোনো আলিম-বুজুর্গের কাছে দুআ চাওয়াতে
অসুবিধা নেই। তবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নিজের জন্য নিজের দুআই
সর্বোত্তম দুআ। এছাড়া দুআর ক্ষেত্রে মনের আবেগ ও অসহায়ত্বই দুআ কবুলের
সবচেয়ে বড় অসীলা। আর বিপদগ্রস্ত মানুষ যতটুকু আবেগ নিয়ে নিজের জন্য
কাঁদতে পারেন, অন্য কেউ তা পারে না।
🔴
৪) অনেকে মনে করেন, আমি পাপী মানুষ আমার দুআ হয়ত আল্লাহ শুনবেন না। এ
চিন্তুা খুবই আপত্তিকর ও আল্লাহ্র রহমত থেকে হতাশার মত পাপের পথ।কুরআনে
বলা হয়েছে, শুধুমাত্র কাফেররাই আল্লাহ্র রহমত থেকে হতাশ হয়। কুরআন ও
হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, পাপ-অন্যায়ের কারণেই মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়
এবং বিপদগ্রস্ত পাপী ব্যক্তির মনের আবেগময় দুআর কারণেই আল্লাহ্ বিপদ
কাটিয়ে দেন।
🔴
৫) হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, “দুআ ইউনূস” পাঠ করে দুআ করলে আল্লাহ্
কবুল করবেন। (লা ইলাহা ইলা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতুম মিনায যালিমীন)
অর্থ- আপনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, আপনি মহা-পবিত্র, নিশ্চয় আমি
অত্যাচারীদের অন্তভূক্ত হয়েছি।
এর মর্মার্থ হলো: “বিপদে ডাকার মত, বিপদ
থেকে উদ্ধার করার মত বা বিপদে আমার ডাক শুনার মত আপনি ছাড়া কেউ নেই। আমি
অপরাধ করে ফেলেছি, যে কারণে এ বিপদ। আপনি এ অপরাধ ক্ষমা করে বিপদ কাটিয়ে
দিন।” আল্লাহ্র একত্বের ও নিজের অপরাধের এ আন্তরিক স্বীকারোক্তি আলাহ এত
পছন্দ করেন যে, এর কারণে আল্লাহ্ বিপদ কাটিয়ে দেন।
🔴
৬) “খতম” ব্যবস্থা চালু করার কারণে এখন আর বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে দুআ
ইউনূস পাঠ বা খতম করে কাঁদেন না। বরং তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যক আলিম-বুজুর্গকে
দাওয়াত দেন। যারা সকলেই বলেন: “নিশ্চয় আমি যালিম বা অপরাধী।” আর যার
অপরাধে আল্লাহ্ তাকে বিপদ দিয়েছেন তিনি কিছুই বলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে
হয়, দাওয়াতকৃত আলিমগণ প্রত্যেকেই যালিম বা অপরাধী, শুধু দাওয়াতকারী
ব্যক্তিই নিরপরাধ!
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের তাওফীক প্রদান করুন।
সুত্রঃ হাদীসের নামে জালিয়াতি
উৎস: কুরআনের আলো
0 Comments