প্রখর রোদে রাস্তার ফুটপাত ধরে হেটে যাচ্ছে সুভাস। এই গরমে তার শরীর ঘেমে একাকার কিন্তু তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ক্লাস শেষ করে আসার সময় মিষ্টি আর মর্ম অনেক জোর করেছিল তাদের সাথে ক্যাফেতে আড্ডা দেওয়া জন্য। কিন্তু সুভাস তাদের মানা করে দিয়েছে যাবে না বলে। মন ভালো নেই, চাইলেও আড্ডা জমাতে পারবে না সে, এই মুহুর্তে তার মাথায় শুধু একটাই জিনিস ঘুরছে, তা হলো মৃত্তিকা। মৃতির সাথে ঐসব কথা না বললেও পারতো। শুধু শুধুই মেয়েটাকে কাঁদিয়েছে। কি দরকার ছিল এইসব বলার, তারও তো নিজের অধিকার আছে নিজের জীবনকে নিজের মতো করে সাজানোর। থাক না কিছু অনুভুতি নিজের মধ্যে। বুঝতে দেওয়ার কি দরকার। আচ্ছা মৃতি যদি তার সাথে আর কথা না বলে? তার কাছ থেকে যদি দূরে সরে যায়? তখন তার কি হবে? আর ভাবতে পারলো না সুভাস। মাথা তিব্র ভাবে ব্যাথা করছে। খুব শীগ্রই বাসায় যেতে হবে।
সন্ধ্যায় হালকা কিছু খেয়েই মৃত্তিকা বসলো তার নিত্যদিনের সব চেয়ে প্রিয় কাজটি করতে। তার প্রিয় কাজটি হলো সারাদিন কি কি ঘটেছে তা ডাইরির পাতায় আবদ্ধ করা। কিন্তু আজ সেই নিত্যদিনের ঘটনা লেখার ইচ্ছে নেই মোটেও। আজ নিজের জীবনের গল্প লেখার ইচ্ছে জেগেছে। কেউই তো নেই তার মনের কথা শোনার মতো। ডাইরিইতে না হয় লিখে নিজের মনকে শান্তনা দিক। মন্দ হয় না কিন্তু। তাই সে লিখতে শুরু করলো --
--"" আমি মৃত্তিকা অঞ্জু। আয়াদ চৌধুরী ও সুমিতি নৈত্রীর এক মাত্র মেয়ে। না এক মাত্র মেয়ে বললে ভুল হবে, চরম ভুল। কারন আমি ছাড়াও তাদের আরও সন্তান আছে। আর আমার বাবা মা বেঁচে থেকেও যেন বেঁচে নেই আমার জীবনে। তারা নিজেদের জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমাকে মনে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে অনেক রকম অসুখি মানুষ আছে, তাদের যদি তালিকা করা হয় তবে তার মধ্যে আমার নাম লিখার যথার্থ কারন আছে। যেমন কেউ টাকা পয়সার অভাবে অসুখি আবার কেও টাকা পয়সা থেকেও অসুখি আর আমি আপনজন না থাকায় অসুখি।
পৃথিবীতে অনেক রকম অসুখি মানুষ আছে, তাদের যদি তালিকা করা হয় তবে তার মধ্যে আমার নাম লিখার যথার্থ কারন আছে। যেমন কেউ টাকা পয়সার অভাবে অসুখি আবার কেও টাকা পয়সা থেকেও অসুখি আর আমি আপনজন না থাকায় অসুখি।
আচ্ছা মায়ের কি আমাকে একটুও মনে পড়ে না? হয়তো পড়ে না। বাবা তো মাঝে মাঝে দেখতে আসে আর টাকার দায়িত্ব পালন করে চলে যায় কিন্তু মা তো আসে না বললেই চলে। আগে যেটুকু আসতো এখন তাও আসে না। মায়ের কথা মনে পড়লে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। তবে বাবা মা দুজনকেই আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, তারা যেমনই হোকনা কেন ।
নানুমনির কাছে শুনেছি বাবা মা নাকি একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। তারা এক সাথে কলেজে পড়তো। প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর একে অপরকে ভাল লাগা থেকে ভালোবাসা। কিন্তু নানুভাইয়ের বারন ছিল তার কোন ছেলেমেয়েই যেন প্রেমের সম্পর্কে না জড়ায়। তার প্রত্যেকটা ছেলেমেয়েকে তার পছন্দ মতোই বিয়ে করতে হবে। ঐ বলে না লেবু বেশি টিপলে তেতো বের হয় ঠিক তেমন যে কাজটা করতে বারন করা হয় ছেলেমেয়েরাও ঠিক সেই কাজটা করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। মাও বাবার সাথে লুকিয়ে প্রেম করে যেত। যতই লুকিয়ে প্রেম করো না কেন ধরা তুমি পড়বেই। নানুভাই বাবা মায়ের সম্পর্কের কথা জানার পর কিছুতেই মেনে নিল না। তারও যুক্তিযুক্ত কারন ছিল। বাবা ছিল মুসলিম পরিবারের আর মা হিন্দু পরিবারের। হিন্দু আর মুসলিমের বিয়ের সম্পর্ক কখনো সম্ভব না। তাই মা নানুভাইয়ের কাছে ধরা খাওয়ার পর নানুভাই বলেছিল বাবাকে যেন ভুলে যায়। মা রাজি না হওয়াতে মায়ের কলেজ থেকে শুরু করে বাইরে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল এবং মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। কিন্তু সেটা আর বেশিদিন চললো না। মা ঠিকই নিজের আপন মানুষ গুলোকে ফেলে বাবার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল সারাজীবন একসাথে পার করবে সেই স্বপ্ন নিয়ে।---""
এইটুকুই লিখে ডাইরি বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মৃত্তিকা। ভেবেছিল আজ সারারাত নিজের জীবনের পুরো গল্প ডাইরিতে লিখবে, কিন্তু তা আর হলো না।কেমন জানি অস্থির লাগছে তার। আপাতত ডাইরি না লেখাই ভালো, নাহলে তার অস্থিরতা আরও বেড়ে যাবে।বাবার সাথে একবার কথা বললে মনে হয় অস্থিরতাটা কমতে পারে। কারন এক মাত্র বাবা-ই তো তাকে বুঝতে পারে। তারপর চেয়ার থেকে উঠে মোবাইল খুজতে লাগলো। অনেক্ষন খোজার পর তার মনে পড়লো যে সে তো ভার্সিটি থেকে আসার পর আর মোবাইল ব্যাগ থেকেই বের করেনি। তারপর মোবাইল ব্যাগ থেকে বের করতেই দেখে অনেক গুলো মিসড কল আর ম্যাসেজ । ক্লাসে ফোন সাইলেন্ট করে রাখার পর বাসায় এসে আর ফোন হাতে না নেওয়াতে সাইলেন্ট মুড চেঞ্জ করতে ভুলে গিয়েছিল। মিসড কল গুলো আর কারো না, সুভাসেরই। মিসড কল গুলোর সময় দেখে বুঝতে পারলো সেই ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই কল দিচ্ছে সে। আবার ম্যাসেজ অপশনে ঢুকতেই দেখলো ম্যাসেজ গুলোও তার। বেশির ভাগ ম্যাসেজই ক্ষমা চাওয়ার। আবার উপরে কিছু ম্যাসেজে লিখা আছে, সে এখন মৃত্তিকার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এইটা পড়তেই মৃত্তিকা দৌড়ে তার বারান্দায় গিয়ে দেখে সত্যি সুভাস তার বাড়ির নিচে এসেছে। রাস্তায় পায়চারি করছিল সে। মৃত্তিকাকে দেখার পর থতমত খেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নিচে পড়ে থাকা বোর্ড এক হাতে উঁচু করে তুলে ধরে আবার আরেক হাত দিয়ে কান ধরে অসহায় চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। বোর্ডে বড় করে সরি লেখা আছে। সিনেমায় দেখেছিল নায়িকা রাগ করলে নায়ক তার বাড়ির সামনে গিয়ে ঠিক এইভাবে সরি বলে নায়িকার রাগ ভাঙায়। সুভাসও নিজেকে নায়কের জায়গায় বসালো আর মৃত্তিকাকে নায়িকার জায়গায়। সুভাসের এই অবস্থা দেখে মৃত্তিকা আসলেই কি রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠতে পারলো না।
চলবে....
0 Comments