Breaking News

বাজির পন্য | লিখা- গোলাম মোস্তফা

ভার্সিটির সুন্দরী মেয়েদের নামের মধ্যে স্পৃহা নামটি ছিল অন্যতম। সুন্দরী হওয়াতে ভার্সিটির কম বেশি সবাই আমাকে চিনত। ভার্সিটির প্রায় অর্ধেক ছেলে এই স্পৃহা নাম বললেই পাগল ছিল। কম বেশি সব ছেলেরাই সুন্দর পূজারী হয়ে থাকে। এমন সুন্দরী মেয়ে জীবন সঙ্গী হিসেবে কে না চায়! এই নিয়ে আমার অহংকারেরও শেষ ছিল না। যেমন টাইপের ছেলেই আমাকে প্রপোজ করুক না কেন আমি ইগনোর করতাম । একরকম ভাব নিয়ে থাকতাম। কারন, আমি অনেক ছেলের দূর্বলতা হলেও আমার দূর্বলতা ছিল 'সীমান্ত'। ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দর আর হ্যান্ডসাম ছেলে। তার সাথে একটু কথা বলার জন্য ভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ে পাগল ছিল। আমিও তাদের মতোই পাগল ছিলাম সীমান্তর জন্য। প্রতিদিন সে audi R8 কার নিয়ে ভার্সিটি আসতো আর যেত। আর সবাই হা করে তাকিয়ে থাকতো। তার সাথে থাকতো তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু 'দৌলত'। সীমান্ত যতটা হ্যান্ডসাম আর সুন্দর ছিল ঠিক তার বিপরীত ছিল দৌলত। দেখে মনে হতো কোনো ফকিরের ঘরের ছেলে। হ্যান্ডসাম তো ছিলোই না বরং এতো ক্ষেত ভাবে চলাফেরা করতো যেন কোনো বস্তির ছেলে। কালো গায়ের রং, এলোমেলো চুল, শার্টের বোতাম সবসময় খোলা থাকতো, গলায় লোহার চেইন,আর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। সীমান্তকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে যে, সে একটা কোটিপতির ছেলে আর দৌলতকে দেখলে বলে দিতে পারবে সে একটা বস্তির ছেলে।
আমার সাথে সাথে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডরাও সীমান্তের জন্য পাগল ছিল। কিন্তু আমি যে তাদের মতোই সীমান্তর জন্য পাগল ছিলাম সেটা কাউকেই বুঝতে দিতাম না। নিজের ভাব নষ্ট করতাম না। তবে যখনই সীমান্ত আমার সামনে পড়তো নিজেকে সামলে রাখতে পারতাম না। অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ৬ ফুট লম্বা, ফর্সা গালে খোচাখোচা দাড়ি, নানারকম কাপড়ের বাহার সব মিলিয়ে সে ছিল যেন কোনো এক দেশের রাজপুত্র। আমি যখন তাকে মন ভরে দেখতাম তখন সীমান্ত আমার দিকে ফিরেও তাকাতো না। যখনই সামনে থেকে চলে যেত তাড়াতাড়ি কেউ বুঝে উঠার আগেই নিজেকে সামলে নিতাম। এইভাবেই চলছিল আমার দিন গুলো।
হঠাৎ একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সাথে ট্রুথ এন্ড ডের খেলছিলাম। বোতল ঘুরে একে একে সবার শেষে আমার দিকে মোড় নিল। সবার চাপাচাপিতে আমি ডের নিলাম সাহস করে৷ আমি ডের নিতেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে বললো, "স্পৃহা তুই তো নিজেকে অনেক সুন্দরী মনে করিস তাহলে তোর এই সৌন্দর্য দিয়ে সীমান্ত ভাইয়াকে কাবো করে দেখা। তবেই আমরা বুঝবো তুই আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী। আর তুই এই ডের করতে পারলে তোকে এর ইনামও দেওয়া হবে। "

আমি আগে থেকেই সীমান্তের জন্য পাগল ছিলাম কিন্তু ডের দেওয়ার পর আমার কাছে সীমান্তকে ইম্প্রেস করা আরও বেশি সহজ হয়ে গেলো। তার সাথে একটা জেদও চেপে বসলো, যে করেই হোক সবাইকে প্রমান করতেই হবে আমিই এই ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী এন্ড লাকি গার্ল।

সব কিছু বাদ দিয়ে আমি লেগে পড়লাম সীমান্তকে পটানোর কাজে। প্রথমেই শুরু করলাম ফেইসবুক দিয়ে। আমি সীমান্তকে ফেইসবুকে রিকুয়েষ্ট পাঠানোর ২দিন পর সে এক্সেপ্ট করে। তারপর নিজ থেকেই নক দেয় সীমান্ত । সেদিন আমার খুশি দেখে কে? এইভাবে আমরা চ্যাট কন্টিনিউ করতে লাগলাম। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম সে আমাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবেসে ফেলেছিল কিন্তু, কখনো বলার সুযোগ হয়নি। এটা ছিল আমার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিন্তু আমি তাকে নিজের ফিলিংস কিছুই বুঝতে দেইনি। একদিন সে আমাকে প্রপোজ করে বসলো ম্যাসেজে। আমি তাকে শর্ত দিয়ে বললাম, যদি সে আমাকে আমার বন্ধুদের সামনে প্রপোজ করে তাহলেই আমি এক্সেপ্ট করবো। সেও রাজি হলো। পরদিন সব বন্ধুদের সামনে সে আমাকে প্রপোজ করলো। বন্ধুদের কাছ থেকে নগদ ৫ হাজার টাকা উসুল করে নিলাম। টাকার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার আলাদা নেশা ছিল। যেকোনো কাজেই আমি টাকার বাজি ধরতাম। আমার মতে, পৃথিবীতে একমাত্র টাকাই মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। টাকার উপর কিছু নেই। না কোনো সম্পর্ক, না কোনো ভালোবাসা। টাকা দিয়ে তো ভালোবাসাও বিক্রি করা যেতে পারে৷ সীমান্তকেও আমি ভালোবাসতাম শুধু মাত্র ওর টাকা দেখে। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম সীমান্ত যে গাড়ি নিয়ে পুরো ভার্সিটিতে এতো ভাব নিয়ে চলে সেটা তার নয়! সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সীমান্ত চলতো দৌলতের জিনিসের উপর৷ তার মানে এই গাড়ি আর রাজকীয় ভাবে চলা সব কিছুই দৌলতের?
সীমান্তের কিছুই নয়! আমাদের ডেটে সীমান্ত যত টাকা খরচ করতো সেটাও দৌলতের টাকা দিয়েই। সব সত্যি জানার পর আমি যেন আমার মধ্যে ছিলাম না। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। শুধু যে উপরের রুপ দিয়েই সব কিছু জাজ করা যায় না সেটা আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। সীমান্ত সবকিছু শিকার করার পর তার সাথে আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। তারপর লেগে পড়লাম দৌলতের পিছনে। একদিন আমি সার্থকও হলাম। শেষ পর্যন্ত দৌলতকে নিজের বানিয়ে ফেললাম। ওইদিকে সীমান্তের চেহারাও আমি দেখতে চাইতাম না। ভুলেও যদি কখনো সামনে পড়ে যেত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতাম তাকে। সীমান্ত অনেকবার ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু আমি তার দিকে ফিরেও তাকাইনি।

আমার বন্ধুরা আমাকে অনেকবার বারণ করেছিল দৌলতের সাথে সম্পর্কে না জড়াতে, "সে ভালো ছেলে না। এর আগেও অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে সে। শুধু টাকা থাকলে হয় না। সে তোর জীবনও নষ্ট করে দিবে। তাছাড়া ও দেখতেও বাজে। তোর সাথে একদমই যায় না। " এইসব বলে বার বার মানা করেছিল তারা কিন্তু আমি মানতে নারাজ ছিলাম। তাদের কথার তোয়াক্কা করতাম না। আস্তে আস্তে সব বন্ধুরা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। তাতে আমার কোনো ভাবান্তর ছিল না। দৌলত কেমন ছেলে তা আমি জেনে বুঝেই তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। দৌলত বস্তির ছেলেদের মতো চলাফেরা করলেও তখন তা আমার ভালো লাগতো। দৌলত যা-ই করুক না কেন আমার কোনো কিছুতে আপত্তি ছিল না। সে তো আমার সব চাহিদা চাওয়ার আগেই পূরণ করছিল তাহলে আর কি লাগে। সপ্তাহে ২-৩বার ডেটে যাওয়া, সাথে শপিং করা তো আছেই আর থাকতো আমার এক একদিনের এক একটা আবদার। চাওয়া পাওয়ার কোনো শেষ ছিল না আমার। এইভাবেই চলছিল আমাদের সম্পর্ক। কিছুদিন পরেই দৌলতও গ্রেজুয়েশন শেষ করে।

হঠাৎ একদিন দৌলত আমাকে বলে তার সাথে রুম ডেটে যেতে। কিন্তু আমি মানা করে দেওয়াতে সে আমাকে অনেক বাজে বাজে কথা শোনায়৷ আমিও তাকে বলে দিয়েছিলাম বিয়ের আগে কিছুই সম্ভব না। আর সে আমাকে বলে যে, 'তোমার পিছনে প্রতি মুহুর্তে এতো এতো টাকা খরচ করলাম আর তুমি আমাকে এইটুকুও বিশ্বাস করো না? ' এছাড়াও সে আমাকে নানা ভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে।তারপরেও আমি মানলাম না। এর মধ্যে অনেক দিন আমাদের মধ্যে কথা বার্তা বন্ধ থাকে। হঠাৎ একদিন আমাকে সে জানায় যে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমি যেন আমার পরিবারকে জানাই। আমিও তার কথায় রাজি হলাম কিন্তু আমার পরিবার রাজি হলো না।
বাংলাদেশের কোটিপতিদের মধ্যে দৌলতের দাদা একজন। দৌলতের বাবা-মা দৌলত ছোট থাকতেই কার এক্সিডেন্টে মারা যায়৷ এরপর থেকেই সে তার দাদার কাছে বড় হয়৷ দাদার কাছেও বলা যাবে না। ঘরের কাজের লোকদের কাছে বড় হয়। তাই সে এতোটা বকে যায়। শাসন করার মতোও কেউ ছিল না। নিজের মতোই চলতো। তার বকে যাওয়ার কথা সবাই জানতো। এমনকি আমিও জানতাম। কিন্তু আমি ওইসব পরোয়া করতাম না। সে যা ইচ্ছে করুক আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ টাকাতেই আমার সব সুখ ছিল।

পরিবারের কেউই যখন মানলো না তখন আমি দৌলতের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ওকে বিয়ে করি। দৌলতের দাদা আমাকে সহজেই বরণ করে নেয়। কিন্তু আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়। তখনও আমার একটুও খারাপ লাগেনি। কারন আমি দৌলতের সঙ্গে সুখে ছিলাম, চরম সুখে।
বিয়ের কিছুদিন পরেই আমরা মালদ্বীপে হানিমুনে যাই। জীবনের প্রথম আমার দেশের বাইরে সফর। তখন আমার চেয়ে খুশি মনে হয়না কেউ ছিল।

বেলা করে ঘুম থেকে উঠা, খাওয়া দাওয়া, শপিং করা, রাতে নাইট ক্লাবে যাওয়া, কয়েকমাস পর পর দেশের বাইরে ট্যুর দেওয়া এভাবেই চলছিল আমার জীবন। ঠিক যেমনটা আমি বিয়ের আগে স্বপ্ন দেখতাম। আস্তে আস্তে আমার সব স্বপ্ন পূরন হচ্ছিল।

হঠাৎ একদিন দৌলতের দাদা তার বিজনেস পার্টনার আর ওনার কিছু বন্ধুদের ইনভাইট করে বাসায়। যখন দাদুর বিজনেস পার্টনার আসে তখন আমি দরজা খুলতে গিয়ে বড় ধরনের শক খাই। সীমান্তকে সামনে দেখে আমি আমার ধ্যান জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিন জানতে পারি সীমান্ত যা বলেছিল সব মিথ্যা। সীমান্তর বাবা আর দৌলতের দাদা অনেক বছর ধরেই বিজনেস পার্টনার। সেদিন গেস্টরা সবাই চলে যাওয়ার পর আমি সীমান্তকে ফোন করেছিলাম। তাকে ফোন করতেই সে ফোন রিসিভ করে অট্টহাসি হেসে আমাকে বলেছিল, "আমি জানতাম তুমি আমাকে ফোন করবেই।" আমি শুধু এইটুকুই বলেছিলাম, " আমাকে মিথ্যা বলেছিলে কেন?"
সে বলেছিল," তুমি সত্যিই কি আমাকে ভালোবাসো কিনা সেটা পরীক্ষা করেছিলাম। বাট তুমি ওইসব থার্ডক্লাশ মেয়েদের মতোই। দৌলত আমাকে তোমার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর অনেকবার বলেছিল তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আর আমিও তোমাকে পাগলের মতো বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তোমাকে মন থেকেই ভালোবেসেছি। তাই দৌলতের সাথে বাজি ধরেছিলাম। আর তুমিও আমাকে ভুল প্রমান করে দিলে নিজের আসল রুপ দেখিয়ে। হেরে গেলাম তোমাকে ভালোবেসে, হেরে গেলাম বাজিতে। আমার কাছে তুমি ভালোবাসা হলেও দৌলতের কাছে তুমি শুধু একটা বাজির পণ্য। আর কিছুই না।"
সেদিন রাগে গজগজ করতে করতে সীমান্তকে যা ইচ্ছে তাই বলে ফোন কেটে দিয়েছিলাম।
বিয়ের এক বছর পর দৌলতের দাদা মারা যায়। বাবা, চাচা, ভাই-বোন কেউ না থাকাতে এতো বড় বিজনেসের সব দায়িত্ব এসে পড়ে দৌলতের কাঁধে। তখন থেকেই দৌলত আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে শুরু করে৷ সারাদিন বিজনেসের নাম দিয়ে বাইরে ফুর্তি করে বেড়ায় আর রাতে জুয়া খেলায় মেতে থাকতো। আর নয়তো নাইট ক্লাবে মেয়েদের নিয়ে। আমাকে দেওয়ার মতো সময় তার ছিল না। যখনই তার পাশে গিয়ে দু-চারটে কথা বলতে চাইতাম তখনই হাতে মোটা মোটা বান্ডিল ধরিয়ে দিতো। আর আমি সেই টাকা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। কিন্তু তাতে শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শপিং থেকে পার্লার, পার্লার থেকে শপিং যা মন চায় তাই করে বেড়াতাম। তারপরেও একটা শূন্যতা প্রতিনিয়ত আমাকে গ্রাস করছিল। দৌলতের কাছে শুধু মাত্র একটুখানি সময় চাইলেই সে বলতো, " টাকা তো দিচ্ছি। যাও মাস্তি করো, আর কি দরকার? এতো সুখ দিচ্ছি তারপরেও সময় চাইছো কেন? তুমি তোমার মতো থাকো আর আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। এরচেয়ে বেশি কিছু এক্সপেক্ট করো না "
সেদিন দৌলতের প্রতিটি কথা আমার গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো লাগছিল। সেদিন থেকে বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে টাকাই সব সুখ নয়। আসল সুখ হচ্ছে জীবনে একজন সঠিক ও ভালো মনের মানুষ পাওয়া।

দৌলতের দাদা মারা যাওয়ার মাসখানের পরেই দৌলতের কারনে তাদের বিজনেসের বড় ধরনের লোকসান হয়। এতে সীমান্তর বাবা বিজনেসের পার্টনারশিপের চুক্তি ফিরিয়ে নেই। এতবড় লোকসান হওয়ার পরেও দৌলতের কোনো ভাবান্তর ছিল না। সে মজে ছিল তার জুয়া আর বারের মেয়েদের নিয়ে। আমি কোনো কিছু বললেই আমাকে বলতো, "আমার কাজ আমাকে করতে দাও। তুমি কি বুঝবে এইসবের। তুমি তোমার মতো থাকো। কত লাগবে শুধু সেটা বলো।"
" আমার টাকার কোনো প্রয়োজন নেই দৌলত।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তাই শুধু তোমাকে কাছে পেতে চাই। আর কিছুই না। প্লিজ এইসব ছেড়ে দাও। তোমার যা চাহিদা আমি পূরণ করবো। আমার এইসব আর ভালো লাগছে না।"
দৌলত তাচ্ছিল্য হেসে বলেছিল,
" ভালোবাসো? সেটা আবার কি? খাই নাকি গায়ে দেয়? শোনো, এইসব কথা অন্তত তোমার মুখে মানায় না। তুমি শুধু আমার টাকাকে ভালোবেসো। তোমার সব চাহিদা টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর সেটা তোমাকে আমি দিচ্ছিই। আর কি লাগে? প্লিজ এইসব জোকস আর বলো না। হাসি পায় আমার।"
দৌলতকে ঠিক যতটা ভালোবেসে ফেলেছিলাম দৌলতের কাছ থেকে ঠিক ততটা অবহেলিত হচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। নিজেকে খুব সস্তা মনে হচ্ছিল। জীবনের শুধু একটা ভুল ডিসিশন আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল।
দৌলত জুয়া খেলায় এতো বেশি মেতে ছিল যে, একসময় এসে পুরো বিজনেস শেষ হয়ে গেলো। ব্যাংকেও কোনো টাকা ছিল না। দৌলত আস্তে আস্তে তার দাদার রেখে যাওয়া সব সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করলো আর সেই টাকা জুয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছিল। একের পর এক জুয়ায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত আমার সব স্বর্ণ বিক্রি করে দিল। হঠাৎ একদিন ব্যাংক থেকে নোটিশ আসলো। দৌলতের দাদা বিজনেসে ইনভেস্টমেন্টের জন্য বড় অংকের টাকা লোন নিয়েছিল সেটা এতো দিন দৌলতের ব্যাংক একাউন্ট থেকে একটু একটু করে কেটে নেওয়া হতো কিন্তু এখন দৌলতের ও ব্যাংকে সব টাকা শেষ তাই কেটে নেওয়ার মতো টাকা তার একাউন্টে নেই। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পুরো দালান বিক্রি করে দিতে হলো। দালান বিক্রি করে দিয়ে আমরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে উঠলাম। দৌলতের হাতে সম্পত্তি বিক্রির কিছু টাকা ছিল। সেটা দিয়ে আমরা আস্তে আস্তে চলছিলাম।
হঠাৎ একদিন বিকেলে কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙে। পাশে দৌলতও ঘুমিয়ে ছিল। আমি উঠে দরজা খুলে সীমান্তকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। দরজা খুলে দিয়ে ওকে বসতে বলি।সে ভিতরে ঢুকে বসে। আমি দৌলতকে ডাকতে যাবো তার আগেই সীমান্ত বলে উঠে, " আমি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি, দৌলতের সাথে নয়। "
আমি থমকে যাই। পিছনে ফিরতেই সে বলল, " জীবনে একটা ভুল ডিসিশন তোমাকে কোথায় এনে বসিয়েছে দেখেছো? তোমাকে আমি আরেকটা সুযোগ দিতে চাই। ফিরে আসো আমার কাছে, ছেড়ে দাও দৌলতকে। সব কিছু ভুলে আমার সাথে চলো। প্রমিস করছি নিজের বেস্ট দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাকে সুখে রাখার। "
" অনেক ভালো আছি আমি। আর দৌলতকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওকে ফেলে কোথাও যাবো না। আর তাছাড়া কার কাছে যাবো? তোমার কাছে? যে লোকটা আমাকে নিজেই তার বন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিল তার কাছে? তোমার চেয়ে তো দৌলত হাজার গুণে ভালো। অন্তত আমাকে বাজির পণ্য ভেবে অন্য কারো হাতে তুলে দেয়নি। যেটা তুমি তুলে দিয়েছিলে। ফিরে যাও সীমান্ত। আর কখনো আমার সামনে আসবে না।"
সীমান্ত অট্টহাসি দিয়ে বললো, " দৌলত তোমার সাথে কি করে সেটা সময় বলে দিবে। "
সেদিন সীমান্ত চলে যাওয়ার পর আমি রুমে এসে দৌলতের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কেঁদেছিলাম। আমার কান্নার শব্দ শুনে দৌলতের ঘুম ভেঙে যায়। আমার কান্না দেখে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে "কি হয়েছে" জিজ্ঞেস করতেই আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, " তোমাকে অনেক ভালোবাসি দৌলত। আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারি না বলো? যা হয়েছে সব ভুলে যাও। আমিও ভুলে যাবো। টাকা পয়সার কোনো দরকার নেই আমার। এখন শুধুই তোমাকে চাই আমি। আর কিছুই না। "
সেদিন দৌলত আমাকে কিছুই বলেনি। চুপ করে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিল। কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। আমাকে ছাড়িয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে বলেছিল, " আজ একটু ভালো কিছু রান্না করো তো। আর সুন্দর একটা শাড়ি পড়। " এই বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। আমি রান্না শেষ করে ঘাস রঙের একটা শাড়ি পড়ে দৌলতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দৌলত বাসায় ফিরে রাত ১০ টার পরে। সাথে নিয়ে আসে ফুলের তোড়া। জীবনের প্রথম দৌলত আমাকে ফুল গিফট করেছিল সেদিন। জীবনের এতো দামি দামি গিফট গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল সেই ফুলের তোড়া। রাতের খাবার খেয়ে আমরা বারান্দায় গল্প করতে বসি। নিজেদের সুখ দুঃখ বিনিময় করতে করতে দুজনই ভালোবাসার সাগরে ডুব দিই।
বেলা ১২টায় ঘুম ভাঙে ফোন কলের শব্দে। পাশ ফিরে দেখি দৌলত নেই। ফোন হাতে নিতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে অপরিচিত একটা নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, " আপনি কি দৌলত চৌধুরীর ওয়াইফ বলছেন? "
" জ্বি। আপনি কে?"
" আমি পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনি একটু পুলিশ স্টেশনে আসুন। "
এইটুকু শোনেই আমার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। দৌলত আমাকে না বলে কোথায় গেছে? সে কি এখন পুলিশ স্টেশনে? সে কি এমন করেছে? ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো কেন? মাথায় নানারকম প্রশ্ন আসতে লাগলো। পুলিশ স্টেশনে গিয়েই দেখি দৌলতের সেই নিথর দেহ পড়ে আছে। এইটুকু দেখেই মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আর কিছুই মনে নেই আমার। জ্ঞান ফিরতেই চোখের সামনে সীমান্তকে দেখতে পাই। আমাদের কাছের কেউ ছিল না বলে দৌলতকে ময়নাতদন্তের পর পুলিশের কিছু লোক আর সীমান্ত তাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
সেদিন বাসায় ফিরে টেবিলের উপর রাখা কাগজটার উপর চোখ পড়তেই খুলে দেখি দৌলতের হাতের লেখা -
" আমি কখনোই তোমার একজন ভালো স্বামী হতে পারলাম না স্পৃহা। আমাকে ক্ষমা করে দিও। " সেদিন
লেখাটা পড়ে জীবনের সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম।
আমার এমন অবস্থার কথা জেনেও আমার বাবা-মা একবারের জন্যও আমার খোঁজ নেয়নি।
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব কিছু ভাবছিল স্পৃহা। বারান্দায় বসে নিজের জীবনের স্মৃতিচরন করতে করতে রাত পেরিয়ে সকালে হয়ে এলো তার কোনো খবর নেই। কি করবে এখন সে? চলবে কেমনে? বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে? যদি মেনে না নেয়? না, বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া যাবে না। নিজেরই কিছু করতে হবে। কিন্তু কে সাহায্য করবে তাকে? কেউ-ই তো নেই। কোথায় যাবে সে? এই মুহুর্তে শুধু মাত্র সীমান্তই তাকে সাহায্য করতে পারে। অন্তত বন্ধুর কারনে হলেও যদি তাকে কোনো একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে হয়তো বাকি জীবনটা এইভাবেই পার করতে পারবে স্পৃহা।
স্পৃহা সীমান্তর কেবিনে ঢুকতেই সীমান্ত তার মুখে বিশ্বজয় করার হাসি ফুটিয়ে বললো,
" ওয়েলকাম স্পৃহা। আমি জানতাম তুমি আসবেই।"
" তোমার সাহায্য দরকার সীমান্ত। প্লিজ আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও। প্রমিস করছি, সারাজীবন তোমার যেকোনো বিপদে পাশে থাকবো। নিজের বেস্ট ট্রাই করবো। "
সীমান্ত অট্টহাসি দিয়ে বললো, " আমিও চাই তুমি সারাজীবন আমার যেকোনো বিপদে আমার পাশে থাকো। তবে সেটা ওয়াইফ হিসেবে। "
" সীমান্ত প্লিজ"
" কিসের প্লিজ? কেন দৌলত তোমাকে কিছু বলেনি?"
" কিসের কথা বলছো?"
সীমান্ত টেবিলের উপর বারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে বললো, " শালা মরেছেই এই কারনে। শালা বিশ্বাস ঘাতক একটা। ব্যাপার না। সব প্রমান আছে আমার কাছে। "
স্পৃহা অবাক হয়ে বললো, " কিসের প্রমান?"
" দৌলত তোমাকে আমার কাছে জুয়ার পণ্য হিসেবে বাজি ধরেছিল। আর সেই জুয়ায় সে হেরে গেছে। শুনো, আমি কখনো আমার জীবনে জুয়া খেলিনি। তবে তোমাকে পাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। ইউ নোউ, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে কে না চায়? তুমিও তো এটাই বলতে, তাই না?"
" প্লিজ বাজে কথা বলো না। আমি এইসব শুনতে চাচ্ছি না। "
" তুমি শুনতে না চাইলেও শুনতে হবে। জুয়া ছাড়াও দৌলত আমার কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা নিয়েছে। সেটা কিভাবে পরিশোধ করবে? আর তোমাকে যে জুয়ার পণ্য হিসেবে আমার কাছে বেচে দিয়েছে সেটাও দৌলতের সাইনসহ প্রমান আছে আমার কাছে। তুমি বলেছিলে না? দৌলত তোমাকে কখনো বাজির পণ্য হিসেবে অন্যের হাতে তুলে দিবে না? তুমি যখন কথাটা বলেছিলে তখন অলরেডি বিক্রি হয়ে গেছো স্পৃহা। "
স্পৃহার নিজের কানে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে দৌলত কেমনে এমনটা করতে পারল। যাকে সে এতো ভালোবেসেছিল আজকে তার হাতেই তাকে বিক্রি হতে হলো?
বেরিয়ে আসলো স্পৃহা সীমান্তর অফিস থেকে। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। টাকা.... শুধু মাত্র এই টাকার লোভে পড়ে সে নিজের জীবন ধ্বংস করেছিল। টাকা কখনোই একটা মানুষ জীবনে সুখের মূল হতেই পারে না। বরং অতিরিক্ত টাকাই মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আমরা জীবনে যখন সব কিছু খুব সহজে পেয়ে যাই তখন সেটার দাম থাকে না। কিন্তু যখন চাহিদা মনের মধ্যে রেখে অনেকদিন পর সেই জিনিসটা পাই তখন তার মূল্যটা অনেক বেশি থাকে। টাকা মানুষকে যতটা উপরে তুলতে পারে তেমনি ঠিক ততটা নিচেও নামাতে পারে।
                                                                          সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments